১২ জুন ২০২৪, ৫:৩৮ এম
১৯.৫ ওভার, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কেশভ মহারাজ, টি টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের প্রথমবার করা ইনিংসের শেষ ওভারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারিটি কয়ার আগে কী চলছিল তার মনে? তিনি জানেন, ব্যাটার মাহমুদউল্লাহর লক্ষ্য একটাই, যেভাবেই হোক বল ছক্কায় ওড়ানো। পুরো ম্যাচে লেন্থ ডেলিভারিতে ভরসা রাখলেও এবার ব্যাটারকে তিনি আটকে দিতে চাইলেন ইয়র্কারে। প্রচণ্ড নার্ভাস থাকার কারণেই কিনা, উল্টো দিয়ে বসলেন ক্রিকেটীয় ভাষায় ‘জুসি’ ফুল টস। অমন পরিস্থিতিতে ছক্কা মারার জন্য সম্ভবত এর চেয়ে সহজ বল আর পেতেন না মাহমুদউল্লাহ। যখন বলটা ব্যাটে লাগল, মনে হচ্ছিল লং অনের ওপর দিয়ে বুঝি ছক্কাই হয়ে যাবে। কিন্তু সেই বল ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত চলে গেল এইডেন মার্করামের কাছে। উচ্চতা কাজে লাগিয়ে নেন সহজ ক্যাচ। মাথায় হাত দিয়ে চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের কোটি দর্শকদের মতো অভিজ্ঞ এই ব্যাটারও যেন বলতে চাইলেন, ‘ইশ, আরেকটু হলেই…’
এই ধরণের টানটান উত্তেজনার ম্যাচ হারের পর যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে খেলোয়াড় থেকে ভক্তদের যদি, কিন্তু এবং আক্ষেপের নানা সংলাপ। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই ম্যাচ তেমন উপকরণ ভালোই দিয়েছে। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের লেগ-বাইয়ের চার রান মিস করা, তাওহীদ হৃদয়ের আম্পায়ার্স কলে আউট হওয়া বা এক-দুটি ওয়াইড না দেওয়া - মাত্র ৪ রানের হারের পর কাটাছেঁড়া চলছে এসব নিয়েই। আর সাথে যোগ হচ্ছে মাহমুদউল্লাহর সেই ছক্কা মিস করে আউট হওয়ার আক্ষেপ।
আরও পড়ুন: আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও পরাজয়ে নিজেদের ব্যর্থতাই দেখছেন তাওহীদ
তবে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, ক্রিকেট ভীষণ জটিল একটি খেলা। সুক্ষ্মতম একেকটি ইভেন্ট এখানে গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য, যা ব্রডকাস্টিংয়ের আধুনিক যুগেও সবসময় আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। পুরো ম্যাচ ছাপিয়ে আমরা যদি ফিরে যাই মহারাজের করা ঘটনাবহুল সেই ২০তম ওভারে, তাহলে এমন কিছুরই দেখা মিলবে, যা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক বৈকি।
১১৪ রান তাড়ায় বাংলাদেশ যেভাবে ব্যাট করছিল, এরপরও ম্যাচ শেষ ওভার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ায় একটা কৃতিত্ব পেতেই পারেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক মার্করাম। তবে সেটা করতে গিয়ে তিনি এমন এক ঝুঁকি নিয়েছিলেন, যা দশবারের মধ্যে নয়বারই দলকে ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। মহারাজের হাতে যে তুলে দেন শেষ ওভারের দায়িত্ব, যে কাজটা পুরো ক্যারিয়ারেই আগে করেননি এই বাঁহাতি স্পিনার।
আর মহারাজই যে এই ওভারটি করবেন, সেটা কয়েক ওভার আগেই ঠিক করে ফেলেছিলেন মার্করাম। একটু যদি খেয়াল করে থাকেন, তাহলেই দেখবেন যে এর আগের ওভারগুলোতে মহারাজের শারীরিক ভাষা ছিল বেশ নার্ভাস। ম্যাচের পর তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, ২০তম ওভারে বল হাতে নেওয়ার চেয়ে এর আগের কয়েকটি ওভারে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
সেটার সত্যতা মেলে প্রথম বলেই। দিয়ে বসেন ওয়াইড। এরপর এক রান দিয়ে ওভারের দ্বিতীয় বলেই আবার তালগোল পাকান মহারাজ। ফুল টস দিয়েও বেঁচে যান, লং অন বল ঠেলে দুই রানের জন্য প্রাণপণ দৌড় লাগান জাকের আলি। তবে মার্করামের করা থ্রো যখন বোলিং প্রান্তে মহারাজের কাছে আসে, তখন ফ্রেমেই ছিলেন না মাহমুদউল্লাহ। তবে ‘চোকার্স’ দক্ষিণ আফ্রিকার যেন পুরনো ভূত ফিরে এসেছিল সেই সময়েই। মহারাজের ঠিক সামনে বাউন্স করে বাজে এক থ্রো করেন ফিল্ডার হিসেবে দুর্দান্ত মার্করাম, যা ধরতেই পারেননি বোলার।
এরপর জাকের আলিকে ফিরিয়ে আর রিশাদকে সিঙ্গেলসে আটকে মহারাজ সমীকরণ নিয়ে আসেন ২ বলে ৬ রানে। মাহমুদউল্লাহ কাবু করতে গিয়ে স্নায়ুর লড়াইয়ে পরাস্ত হয়ে করে বসেন এমন এক ডেলিভারি, যেন আমন্ত্রণই ছিল যে ‘আমাকে ছক্কা মারুন।’ স্লটে পাওয়া ফুল টসে সজোরে ব্যাটও চালিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ, কিন্তু কয়েক মিটারের জন্য আর পারেননি জয়-পরাজয়ের ব্যবধান হতে।
খালি চোখে দেখলে মনে হতেই পারে, শটে ছিল না পর্যাপ্ত জোর। আসলেই কী তাই? কারণটা বলেছেন মহারাজই। মাহমুদউল্লাহকে তিনি ইয়র্কারই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বল তার হাত থেকে বের হওয়ার পরই নাকি বাতাসের প্রভাবে তা ভেসে পরিণত হয় ফুল টসে। ক্রিকেট খেলাটাকে শুরুতেই জটিল বলেছিলাম, কারণ মহারাজকে যা বিপদে ফেলেছে, ঠিক সেটাই আবার মাহমুদউল্লাহ তথা বাংলাদেশকে ডুবিয়েছে।
মাহমুদউল্লাহ যে শটটা নিয়েছিলেন, সেটা ভালোভাবেই ছক্কা হওয়ার পথেই ছিল। লং অনে থাকা মার্করামেরও সেটাই মনে হয়েছিল প্রথমে। আর এই কারণেই তিনি ক্যাচ নেওয়ার আগে এক নজর দেখে নিয়েছিলেন বাউন্ডার লাইন। কারণ, ক্যাচ না হলে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে বলটা মাঠের ভেতর রাখার একটা চেষ্টা তিনি যাতে নিতে পারেন। সেটা বুঝতে পেরে লং অফে থাকা মার্কো ইয়ানসেনও চলে আসছিলেন মার্করামের বেশ কাছাকাছি, উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, মার্করাম বলটা মাঠের ভেতরে পাঠালে তিনি যেন জুটি বেঁধে ক্যাচটা সম্পন্ন করতে পারেন।
আরও পড়ুন: ওয়ানডে মেজাজের ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে হারানোর খুশি ক্লাসেনের
কিন্তু যে বাতাসের প্রভাবে ফুল টস পেয়েছিলেন, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মাহমুদউল্লাহর জন্য। তার শটে যথেষ্ট জোর থাকার পরও তাই শেষ মুহূর্তে বিপরীত দিক আসা বাতাসে বাড়ি খেয়ে বলটির গতি কমে নিচু হয়ে যায়। ফলে যে ক্যাঁচটা বাউন্ডারি লাইনে লাফিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি ছিল মার্করামের, সেটা কয়েক মিটার এগিয়ে এসে অনায়াসেই তার হতে জমা হয়। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখেছি, মার্করাম বাউন্ডারির সামনে বাঁদিকে দৌড়ে ক্যাচটা নিয়েছেন।
তবে সেটা কেবলই এক ঝলক। এর আগে মাহমুদউল্লাহ শটটি মারার পর মার্করামের হাতে ছিল স্রেফ চার সেকেন্ড। এই সময়ের মধ্যেই তিনি বলটি ছক্কা হবে বলে ধরে নিয়েছেন, বাতাসের প্রভাবে বলের গতি বদলে যেতে দেখেছেন এবং চোখের পলকেই সেভাবে পজিশন নিয়ে ক্যাচটা নিয়েছেন - এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই আদতে একটা রোমাঞ্চকর ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেয়। যা খালি চোখে হয়ত দেখা যায় না, তবে ৪০ ওভারের লড়াইয়ে কে জিতবে আর কে হারবে, সেটার নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ, মাহমুদউল্লাকে অবশ্য এই ম্যাচ, এই শট বার বার মনে করিয়ে দিবে একটাই হাহাকার, ইশ, আরেকটু হলেই…
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ পিএম
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ পিএম
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৪ পিএম
আরও পড়ুন
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার আশা শেষ ইউনাইটেডের |
“ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল কতটা ভালো করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দিহান দেশের একমাত্র উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ।”