“আমি টনির অনু্শীলন দেখতে পছন্দ করি। তার অনুশীলন সেশনে থাকতে আমার ভালো লাগে। সেটা একেবারেই ব্যতিক্রমী সেশন হয়। আমি এটার শুধু বলার জন্য বলছি না। এটাই সত্য। আমি তাকে কখনোই বল হারাতে দেখিনি। ঠিক আছে, হয়তো একবার। তবে তার কোনো খারাপ দিন যায় না।” রিয়াল মাদ্রিদের কোচ থাকা অবস্থায় কথাগুলো বলেছিলেন ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ডারদের একজনের কাছ থেকে এমন স্বীকৃতিই তো যথেষ্ট টনি ক্রুসকে চেনার জন্য। এরপর ফুটবলকেন্দ্রীক আলোচনায় যাওয়াটাই আসল বৃথা। তার চেয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ও জার্মানির এই তারকা মিডফিল্ডারকে বরং একটু দেখা যাক মাঠের জগতে ছাপিয়ে বাইরে থেকেই৷ যা তাকে করেছে সবার চেয়ে আলাদা, নাহ, একটু বেশিই আলাদা।
জনপ্রিয় একটা প্রবাদ আছে, ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’। টনি ক্রুসকে নিয়েও যদি এটা বলা হয়, খুব কী ভুল হয়ে যাবে? গত মঙ্গলবার পুরো ফুটবল বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়ে আচমকাই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন তিনি। সেটাও খুব সাদামাটা একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে। ব্যস, এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদের ভক্তদের মাতম যেন আর থামবারই নয়। বিস্ময় নিয়ে আক্ষেপের সুরে তাকে নিয়ে নানা পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন সাবেক ও বর্তমান সতীর্থরা। জার্মান হলেও ১০ বছরের অধ্যায়ে রিয়ালে এমনই এক মায়ার বন্ধন গড়ে তুলেছেন নিপাট ভদ্রলোক ক্রুস, তাতে তার অবসর নিয়ে জার্মানির চেয়ে স্পেনে, বিশেষ করে রিয়ালের প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চ্যানেল, পেজ ও গ্রুপে শুধুই হাহাকার বয়ে যাচ্ছে কাল থেকে আজ অবধি। এমন একটা মুহূর্তে একজন খেলোয়াড় কী করতে পারেন?
আবেগ সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা? চোখের কোনে জল নিয়ে তাকে নিয়ে সবার পোস্টগুলো দেখা? নাহ, ক্রুস তো আর দশজন ‘সাধারণ’ ফুটবলার নন। বলা যায়, সাধারণ মানুষই যে নন তিনি। অন্যরা যাই করুন না কেন, ওই ঘোষণার পর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ক্লিপসে ক্রুসকে তাই দেখা গেল রিয়ালের অনুশীলন মাঠে বসে বসে অরেঞ্জ জুস খেতে। সামনে অলস চাহনি দেখে মনে হতেই পারে, এই বুঝি সানডে লিগ খেলে এসেছেন এক তরুণ ফুটবলার। বিস্ময়ের শেষটা এখানে হলেও ভালোই ছিল। নিরাবেগ থেকে এরপর একে একে সবার পোস্টের রিপ্লাই দিচ্ছিলেন। এর মাঝেও করে বসেন এক টুইট, “আমি অন্তত ট্রেন্ডিংয়ে আছি তো?"
অবশ্য রিয়াল ও জার্মানির ভক্ত এবং ইউরোপিয়ান ফুটবল যারা নিবেদিতভাবে অনুসরণ করেন, তাদের কাছে ক্রুসের এই ধরণের কর্মকান্ড খুব একটা অবাক করার নয়। তিনি তো এমনই। তার বিয়ে (অবসর) নিয়ে চারদিকে হুলস্থুল, আর তিনি কিনা ব্যস্ত আছেন জুস খেতে আর ট্রেন্ডিংয়ে আসতে পারলেন কিনা, তা নিয়ে! এও সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। ক্রুস যে সাধারণের মাঝেও অতি অসাধারণ এক মানব। কেবল তার পক্ষেই তো এমন কাণ্ড ঘটানো সম্ভব।
খেলোয়াড় হিসেবে ক্রুস কেমন, সেটার জন্য পরিসংখ্যানের ডালি সাজিয়ে বসতে হবে আপনাকে। ‘সাইড পাসার’, ‘ওল্ড স্কুল’ খেতাব পাওয়া ক্রুস যে আসলে আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডারদেরই একজন, সেই বিষয়ে বোধকরি তার নিন্দুকেরাও এখন আর কিছু বলেন না। আসলে, তাদের বোলার সুযোগই দেননি ‘জার্মান স্নাইপার’। একটি বিশ্বকাপ, চারটি চ্যাম্পিয়স লিগ (১ জুন যোগ হতে পারে আরও একটি), লা লিগা, বুন্দেসলিগা সহ আরও অনেক শিরোপা রয়েছে তার ঝুলিতে। আর বছরের পর বছর ধরে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে সর্বোচ্চ নিখুঁত পাস দেওয়ার মত ‘মামুলি’ কিছু তথ্য-উপাত্ত তো আছেই।
তবে ক্রুস সবার চেয়ে আলাদা ফুটবল ছাপিয়ে আরও অনেক কারণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিয়াল তো বটেই, সমসাময়িক ফুটবলারদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ‘সারকাস্টিক’ পোস্ট, কমেন্ট তিনিই করে থাকেন। জার্মান হলেও এসব ক্ষেত্রে ৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার একেবারেই বেমানান। অনেকেই বরং তার সাথে মিল পান ইংলিশদের। খেলা নিয়ে ক্রুসের চিন্তাভাবনাও অবশ্য অনেকটা তেমনই। এই যেমন, ফুটবলকে খুব বেশি সিরিয়াসলি না নেওয়া বা অবসরের বয়সের প্রসঙ্গ।
বরাবরই বলেছেন, ৩২ বছরের পরই নিজেকে ফুটবলে বেশিদিন চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তিনি দেখেন না। যতদিন খেলবেন, শীর্ষ ফর্মে খেলবেন, এরপর মধ্য ত্রিশে নেবেন অবসর। এরপর অফুরন্ত বেকার সময় কাটিয়ে পরিবার নিয়ে জীবন উপভোগ করার চেষ্টা। ঠিক এভাবেই জীবনটাকে দেখেন বলেই এমন অবিশ্বাস্য একটা মৌসুম কাটানোর পরই নিয়ে নিলেন অবসর। যেখানে তার প্রিয় বন্ধু লুকা মদ্রিচ ৩৮ বছর বয়সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠ। তবে অন্যরা যা ভাবেন, করেন, ক্রুস তো সেই পথ মাড়াবেন না।
২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালই যেমন। ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এবং চাপের ম্যাচ তো এটিই। লিভারপুলের বিপক্ষে সেই ফাইনালের বিরতিতে দুই দল যায় গোলশূন্য সমতায়। সেই ম্যাচের পর একটি ভিডিও বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে দেখা যায় ড্রেসিংরুপে হেয়ার কাট ঠিকঠাক করায় ব্যস্ত ক্রুস। প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতির ম্যাচেও তো খেলোয়াড়দের এতটা গাছাড়া ভাব দেখা যায় না। কিন্তু হায়, তিনি তো ক্রুস!
চার বছর পর আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল, প্রতিপক্ষ সেই লিভারপুল। টিকেট নিয়ে ঝামেলার কারণে ম্যাচ শুরু পিছিয়ে যায় ত্রিশ মিনিটের বেশি। ড্রেসিং রুমে এসে এই ব্যাপারটি খেলোয়াড়দের জানান রিয়ালের কোচ কার্লো আনচেলত্তি। দলের সবাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একজন বলে উঠলেন, “সমস্যা নেই, আমরা একটু দেরিতে চ্যাম্পিয়ন হব।” আন্দাজ করুন তো কে হতে পারেন সেই খেলোয়াড়টি!
মাঠের বাইরের মত মাঠেও ক্রুস বরাবরই নিরাবেগ এক চরিত্র। নিজে দারুণ একটি গোল করুন বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা হোক, বিশ্বকাপ জয়ী এই মিডফিল্ডার কখনই বাধভাঙ্গা উল্লাসে মেতে ওঠেননি। তবে এই মৌসুমে বারবার তাকে দেখা গেছে বুনো উদযাপন করতে। যে দেখে বিস্ময় জেগেছে বেশ। এটা কি সেই চেনা ক্রুস? তিনি কেন অন্যদের মত এত আনন্দ উৎসব করছেন ‘সামান্য’ অর্জনে? হয়ত এই কারণেই যে, বেশ আগে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে পেশাদার ফুটবলে নিজের শেষ মৌসুমে হয়ত চেয়েছেন নিজেকে মুক্ত পাখির মত ছেড়ে দিতে।
ক্রুস আসলে ফুটবলের এমন এক শিল্পী, যাকে গোল, শিরোপা, ব্যালন ডি'অর এসব দিয়ে আপনি মাপতে পারবেন না। তুলির আঁচড়ে মাঝমাঠে নীরবে তিনি একে যান মায়াবী একেকটি শিল্পকর্ম, যা কোনো পরিসংখ্যানের মানদণ্ড দিয়ে বিচার করা যায় না। এমনকি অনেক সময় গোটা একটা ম্যাচ দেখার পরও আপনার প্রশ্ন জাগতেই পারে, ক্রুস আসলে করল টা কী? এই প্রশ্নটাই তার সতীর্থদের করলেই শুনবেন একেকটি রচনা। মাঠে তার প্রভাবটা তো এমনই। স্পটলাইট তিনি কখনও চাননি, কারণ ওসব বয়ে বেড়ানোর জন্য যেমন ব্যক্তিত্ব বয়ে বেড়াতে হয়, তিনি তিনি তেমন নন।
ক্রস তাহলে কেমন? উত্তরটা দেবে তার বুট। নাহ, চমকে যাবেন না। ক্রুসের বুটের যে আছে বিরল এক গল্প। এখন এমন একটি প্রজন্ম চলছে ফুটবলে, যেখানে খেলোয়াড়রা বিভিন্ন রঙ, ডিজাইন ও আকৃতির বুট বেছে নেয় বার্তা এবং নিজের ব্র্যান্ডের প্রচারণার জন্য।
সেখানে ক্রুস পরে আছেন সেই ‘মান্ধাতার আমলের’ বুট নিয়ে। নতুন নতুন ডিজাইন আসছে প্রতিনিয়ত, তবে ক্রুস এখনও খেলছেন এক যুগের বেশি পুরনো ‘এডিডাস এডিপিউর ১১প্রো বুট’ নিয়েই। পেশাদার ফুটবলারদের বুট সরবরাহের বিশেষজ্ঞ বেন ওয়ারেন দ্য অ্যাথলেটিককে একবার ক্রুসের বুটপ্রীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “সে এটা নিয়ে যা করে তা স্রেফ পাগলামি।”
এডিডাস অনেকবার চেষ্টা করেছে নতুন মডেল গছিয়ে দিতে। বাহারি ডিজাইন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কত টোপ দেওয়া হল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্রুসের সাফ কথা, স্রেফ এই মডেলের বুট পরেই তিনি খেলবেন। ফলে হারিয়ে যাওয়া এই মডেলের বুট এখনও শুধুমাত্র তার জন্যই আলাদাভাবে তৈরি করে যাচ্ছে এডিডাস, যা এখন একটা ভিন্ন ট্রেন্ডই হয়ে গেছে। তার অবসরের সাথে সাথে এখানেও একটা যুগের অবসান হতে যাচ্ছে।
খেলোয়াড় হিসেবেও ক্রুসের বিদায়ে একটা যুগেরই তো অবসান হতে যাচ্ছে। ফুটবলে মিডফিল্ডারদের গুরুত্ব নিয়ে ক্রুস একবার বলেছিলেন, “মিডফিল্ডে আধিপত্য বিস্তার করা আধুনিক ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সফল হতে হলে সব কিছুতেই ভালো হতে হবে।”
শেষের এই লাইনটাই যথেষ্ট ক্রুসকে তুলে ধরতে। তিনি সফল, কারণ তিনি তো সব কিছুতেই ভালো। আর কথায় আছে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। যেভাবে সেরা ফর্মে থেকে অবসরে যাচ্ছেন, তাতে শেষটা তো সবদিক থেকেই ভালো ক্রুসের। রিয়াল মাদ্রিদে খেলে অবসরে যেতে পারাটা ক্লাব ফুটবলের অন্যতম কঠিন কাজ। অনেক কিংবদন্তিরাও তা পারেননি৷ ক্রুসের আগে কাজটা শেষ করতে পেরেছেন একজন, তিনি হলেন জিদান। ক্রুস নিজেকে কোন কাতারে নিয়ে গেছেন, সেটা বোঝার জন্য এটুকুই তো যথেষ্ট। আর স্বয়ং জিদানের চোখে ক্রুস কেমন ফুটবলার, তাতো আগেই জানলাম আমরা। তো আর বাকি রইলো কী? অবশ্যই ক্রুস-নামা, যা চলবে যুগ যুগ ধরে।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:১৮ পিএম
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পিএম
বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলা |
“দুই সেশনেও নেই সাকিব, শেষ সেশনে কি দেখা যাবে”