১১ মে ২০২৪, ৩:৪৯ এম
ফুটবলে দেশ-বিদেশ ছাপিয়ে খেলাটির ভক্তদের মধ্যে মজার ছলে বলা একটি বাকি বেশ জনপ্রিয় - ‘তিনি কী এটা স্টোক সিটির ঠাণ্ডায়, বৃষ্টির রাতে করতে পারবেন?’ সেটা লিওনেল মেসি হোক আর ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, কমবেশি সবাইকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মানদণ্ড হিসেবে এটাই বলা হয়ে থাকে। মোদ্দা কথা হল, আপনি অনেক বড় ফুটবলার হতে পারেন, বিশ্বকাপও জিততে পারেন, তবে স্টোক সিটির বৃষ্টিভেজা রাতে যদি নিজেকে নাই প্রমাণ করতে পারলেন, তাহলে আপনি কেমন ফুটবলার হলেন? ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন? খুব স্বাভাবিক। তবে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলটা যারা নিয়মিত দেখেন, খোঁজ রাখেন, তাদের কাছে স্টোক সিটির ওই ঠাণ্ডার রাতে ভিজে যে ভালো করবে, সেই তো সেরা। মজাটা এখানেই।
কিন্তু হোসেলু এমন এক বিরল ফুটবলার, যিনি সেই স্টোক সিটিতে অনেক আগেই নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে হয়েছেন ব্যর্থ। ঠাণ্ডায় জমে আর বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে ম্যাচের পর নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। মজার ছলে বলা হলেও ইংলিশ ক্লাবটিতে তিনি সেরাটাই দিতে চেয়েও পারেননি। উল্টো এরপর ক্যারিয়ার ক্রমেই হচ্ছিল নিম্নগামী।
পাকেচক্রে গত গ্রীষ্মে যখন রিয়াল মাদ্রিদে চলে আসেন, সংবাদমাধ্যম তো বটেই, ক্লাবটির ভক্তদের মুখেও ছিল একই প্রশ্ন - ‘তিনি কি রিয়াল মাদ্রিদে খেলার যোগ্য?’ বিশেষ করে যে খেলোয়াড়টি আবার আগেই ব্যর্থ হয়ে এসেছেন স্টোক সিটিতে, তিনি কিনা গোটা মৌসুমে থাকবেন রিয়ালের মত অভিজাত ক্লাবের একমাত্র স্ট্রাইকার হয়ে। এত দুর্দিন নিশ্চয় আসেনি তাদের!
অবশ্য এই ভাবনায় খুব একটা দোষেরও কিছু নেই। মাত্রই ক্লাব ছেড়েছেন আগের মৌসুমে ব্যালন ডি'অর জয়ী করিম বেনজেমা। যিনি আদতে স্ট্রাইকার হলেও পুরো দলের খেলাকে যেভাবে একবিন্দুতে রাখতেন, বিশ্ব ফুটবলে এমন মাপের আরেকজন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপারই। তার সাথে যদি যোগ করা হয় রিয়ালের ইতিহাসের শীর্ষ পাঁচ গোলস্কোরারদের একজন হওয়া, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বড় ম্যাচে নিয়মিত জ্বলে ওঠার মত ব্যাপার, তাহলে তার বিদায়ের পর কাছাকাছি একজন খেলোয়াড় তো সমর্থকরা তো চাইবেনই।
কার্লো আনচেলত্তির চাওয়াটাও ছিল একই। ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের দাবি জানিয়েছিলেন বড় মাপের একজন স্ট্রাইকারের জন্য। তার ‘রেডিমেড’ পছন্দ ছিলেন হ্যারি কেইন। বেনজেমার মত তিনিও স্ট্রাইকার হলেও দারুণভাবে করতে পারেন প্লেমেকিংও। দুজনের মধ্যে আরও একটি বড় মিল, তারা স্বার্থপর নন এবং দলকে এগিয়ে রাখেন সবার আগে। তবে কিলিয়ান এমবাপের জন্য প্রতি গ্রীষ্মে বিশাল বাজেট বরাদ্দ রাখা পেরেজ হতাশই করেন আনচেলত্তিকে। কেইন তো বাদই, হাই-প্রোফাইল অন্য স্ট্রাইকার কেনাতেও না করে দেন।
কাজ চালিয়ে নেওয়ার খাতিরে রিয়ালের নজর যায় ‘দামে কম, মানে ভালো’ প্যাকেজ হোসেলুর দিকে। গেল মৌসুমে অর্থনৈতিক দুর্দশায় থাকা এস্পানিওল নেমে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। নামমাত্র মূল্যে এক মৌসুমের জন্য তাকে ধারে নিতে রিয়ালের প্রস্তাব ফেরানো তাই দলটির জন্য ছিল অসম্ভব।
বেনজেমার সম্ভাব্য বিকল্প কেইনের জায়গায় রিয়াল তাতে মৌসুমে শুরু করে একমাত্র স্ট্রাইকার হোসেলুকে নিয়ে, যিনি কিনা এর আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই খেলেননি! জুড বেলিংহামের অবিশ্বাস্য গোল ফর্ম, দুই পাশে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রদ্রিগোর কম্বিনেশনের সাথে বেঞ্চের প্রতিযোগিতা - সব মিলিয়ে শুরু থেকেই সেরা একাদশের বাইরে থাকতে হয়। অপেক্ষায় থাকেন সুযোগের, এই ৩৪ বছর বয়সে নিজেকে প্রমাণ করার। স্টোক সিটিতে না পারলেও রিয়ালে যে তার কিছু দেখানোর তাগিদটা ব্যক্তিগতও বটে।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০২২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের ঠিক আগে একটি ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছিল। হোসেলু নামের এক স্প্যানিশ স্ট্রাইকার রিয়ালের জার্সি পরে সমর্থন দিতে চলে গেছেন স্টেডিয়ামে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পেশাদার মোড়কে থেকেও তার এই রিয়াল ভক্ত বনে যাওয়াটাই যথেষ্ট ক্লাবটির প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শন বোঝাতে। সেদিন হোসেলুর গায়ে ছিল রিয়ালের স্প্যানিশ ডিফেন্ডার দানি কারভাহালের জার্সি…
অবশ্য হোসেলুর ‘রিয়াল মাদ্রিদ প্রেম’ তো বেশ পুরনো। ক্লাবটির একাডেমিতেও খেলেছিলেন একটা সময়। তবে মূল দলে আর সুযোগ করতে পারেননি। মাঝের সময়টা ক্যারিয়ারে গেছে কঠিন সময়ে। সেই সময়ে ১২ বছর আগে রিয়ালের একটি ম্যাচ দেখার সময় আর দশজন ভক্তের মতই একটা টুইট করেছিলেন। “কারও কাছে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচ দেখার ভালো একটা লিংক হবে?” - অমন একটা টুইট করার সময় হোসেলু কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন, এই ক্লাবের জার্সিতেই একদিন তার ম্যাচ দেখতে অজস্র ভক্তরা লিংক চাইবে?
তবে ‘লেট ব্লুমার’ হোসেলুর ক্যারিয়ার ত্রিশের পরে এসে যেন পেয়েছে নতুন গতি। স্পেন জাতীয় দলেও হয়ে গেছে অভিষেক, রিয়ালের হয়ে এরই মধ্যে স্বাদ পেয়ে গেছেন লা লিগা জয়েরও। আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ?
ফুটবলে রুপকথার গল্পের তো শেষ নেই৷ চলতি মৌসুমে ৪৯ ম্যাচ ধরে অপরাজিত জার্মান ক্লাব লেভারকুসেনই যেমন। হোসেলুর গল্পটাও তো এরচেয়ে কম নয়। তারকায় ঠাসা একটা দলের স্ট্রাইকার তিনি, যার একাদশেই জায়গা হয় না। মূল ভূমিকা বদলি নেমে কিছু গোল করে দেওয়া। ভালো করলেও নেই বাড়তি প্রশংসা। আলো কেড়ে নেন কখনও ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, কখনও বা জুড বেলিংহাম। তবে ফুটবল বিধাতা হোসেলুর মত ‘ব্রাত্য’ দের জন্যও রেখে দেন কিছু মূহুর্ত। যেখানে তারাদের মাঝে হোসেলুরা জ্বলজ্বল করেন চাঁদ হয়ে।
বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ফিরতি লেগে হোসেলু যখন নামেন, নির্ধারিত সময়ের ৯ মিনিট বাকি থাকতে এক গোলে পিছিয়ে বাদ পড়ার পথে রিয়াল। মিনিট খানেক বাদে ভিনিসিয়ুসের নেওয়া জোড়াল শট বিস্ময়করভাবে গ্রিপ করতে ব্যর্থ হন পুরো ম্যাচে অসাধারণ সব সেভ করা মানুয়েল নয়ার। বল গিয়ে পড়ল সেই হোসেলুর সামনে, যিনি মিরাকলের আশায় সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আচ্ছা, আলতো টোকায় বল জালে পাঠিয়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যখন আনন্দের রেণু ছড়িয়ে ছুটছিলন হোসেলু, তখন কী ভাবছিলেন তার স্টোক সিটির সতীর্থরা? ঘোর লাগা চোখে নিশ্চয় ভাবছিলেন, এটা কী আমাদের সেই হোসেলু!
তবে ম্যাচের সব আলো কেড়ে নিতে হোসেলুর প্রয়োজন ছিল আরও বিশেষ, আরও ইতিহাস গড়া মূহুর্তের। যা মিলে যায় ইনজুরি টাইমে, আবারও সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থেকে পেয়ে যান জালের দেখা। দুই দলের সব রথীমহারথীদের ছাপিয়ে জয়ের নায়ক হয়ে গেলেন হোসেলু। ম্যাচ শেষে তিনি নিজেও বলেছেন, স্বপ্নেও নাকি এমন কিছু ভাবতে পারেননি তিনি। খুব স্বাভাবিক, এমন পরাবাস্তব ঘটনা তো প্রতিদিন ঘটবে না। আর হোসেলুর ক্ষেত্রে হয়ত আর কখনই নয়, অন্তত ‘অল হোয়াইট’-দের হয়ে।
কারণটা খুব স্পষ্ট। আগামী মৌসুমে ব্রাজিলের প্রতিভাবান তরুণ স্ট্রাইকার এন্দ্রিক যোগ দিচ্ছেন রিয়ালে। কিলিয়ান এমবাপের আসার খবরও যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে তারও কার্লো আনচেলত্তির রিয়ালে আসাটা সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। আগে থেকেই যে দলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এই দুজনের আগমনের পর হোসেলুর খেলা তো পরে, ক্লাবে থাকাটাই পরে যাবে অনিশ্চয়তার মুখে।
তবে তার আগে হোসেলু খেলবেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। স্টোক সিটির বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডার মধ্যে যিনি ‘এটা’ করে দেখাতে পারেননি, তার গলায় উঠতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মেডেল। খুব একট মন্দ অর্জন নয়!
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:১৮ পিএম
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পিএম
বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলা |
“দুই সেশনেও নেই সাকিব, শেষ সেশনে কি দেখা যাবে”